গুরুতর উদরাময়জনিত রোগকে কলেরা বলা হয়ে থাকে। রোগটি আমাদের দেশে প্রায়ই মহামারী আকারে বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিত। বর্তমানে উন্নত চিকিৎসাসেবা ও প্রতিশেধকের ব্যবহারে রোগটির প্রকোপ বহুলাংশে প্রশমিত হয়েছে। কলেরা সংক্রমণ অনেক সময় কোনো উপসর্গ ছাড়াই হালকাভাবে প্রকাশ পায় আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত মারাত্মক আকারে দেখা দেয়। লিখেছেন ড. জাকারিয়া আহমেদ
কলেরা একটি সংক্রামক রোগ; এর জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে দেহের ক্ষুদ্রান্ত্রের পানি শুষে নেয়ার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। কলেরা রোগের বিপজ্জনক চরিত্র হচ্ছে শরীরের পানির ব্যাপক ক্ষরণ ঘটিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে রোগীর জীবন বিপদাপন্ন করে তোলে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুদের জন্য এই রোগটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। কলেরা আক্রান্ত রোগীর জন্য দ্রুত চিকিৎসাব্যবস্থা না নেয়া হলে পানিশূন্যতার কারণে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। এই রোগের চিকিৎসা তেমন জটিল নয় বরং অত্যন্ত সহজ। পানির সাথে প্রয়োজনীয় মাত্রায় চিনি ও লবণ মেশানো পানি ঘন ঘন রোগীকে খাইয়ে তার শরীরের পানিশূন্যতা পূরণ করে দেয়া এই রোগের অন্যতম প্রধান চিকিৎসা। শুধু সাধারণ পানিতে এই শূন্যতা পূরণ হয় না। গুরুতর রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করে ইনজেকশনের মাধ্যমে সরাসরি ধমনীতে লবণাক্ত পানি (স্যালাইন) রক্তের সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে কলেরা শুধু উষ্ণ অঞ্চলীয় রোগ নয়। তবে এর সাথে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা ও বিশুদ্ধ পানির বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে। রোগাক্রান্ত অঞ্চলে উন্নত মল নিষ্কাশন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যব্যবস্থা এই রোগ প্রতিরোধ ও বিস্তারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কলেরা মহামারী অঞ্চলে শুধু বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ৯০ শতাংশ রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায়।
Vibrio Cholerae নামক জীবাণুর আক্রমণে কলেরা হয়ে থাকে। খাদ্যের মাধ্যমে এই জীবাণু মানবদেহের পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে সেখানে এক প্রকার বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে, যার ফলে এই রোগটি হয়ে থাকে। কলেরা জীবাণুর এই বিষাক্ত পদার্থ মানুষের পরিপাকতন্ত্রের কোষগুলো ধ্বংস করে দেয়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির পাতলা পায়খানা হতে শুরু করে এবং তাতে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এই পানিশূন্যতা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে রোগীর জীবনে মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। কলেরা জীবাণু মিশ্রিত খাদ্য খাবার অথবা পানি গ্রহণ করলে মানুষ কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। কলেরা উপদ্রুত মহামারী অঞ্চলে রোগীর মলমূত্রের মাধ্যমেও এই রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। যেসব অঞ্চলে পয়ঃনিষ্কাশন ও বিশুদ্ধ পানির যথাযথ ব্যবস্থা নেই, সেসব অঞ্চলে কলেরা অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করে থাকে। সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল এবং লোনাপানির নদ-নদীতে কলেরা জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে। তা ছাড়া কঠিন বহিরাবরণবিশিষ্ট মাছ কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক ও চিংড়িমাছের মধ্যেও কলেরা জীবাণু বেঁচে থাকে এবং তা কলেরার উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে। কলেরা আক্রান্ত রোগীর সাথে সরাসরি শারীরিক সংস্পর্শে এই রোগ সংক্রমণ হয় না। তাই রোগীর সেবাদানকারী ব্যক্তিদের সংস্পর্শজনিত সংক্রমণের কোনো ঝুঁকি থাকে না।
কলেরার সংক্রমণ : কলেরায় আক্রান্ত রোগীর ঘাম ও মলের মধ্যে কলেরা জীবাণু বেঁচে থাকে এবং সেই জীবাণু যদি কোনোভাবে পানির মাধ্যমে মানবদেহে যায় তবে কলেরা আক্রান্ত হবে। তা ছাড়া মল ত্যাগ করার পর হাত ভালো করে সাবান নিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার না করে নিলে হাতে থাকা জীবাণু খাবারের সাথে মানবদেহে অনুপ্রবেশ করে রোগের আক্রমণ ও বিস্তার ঘটাতে পারে এবং মানুষ রোগাক্রান্ত হয়। নোংরা পানির মাছের মধ্যেও কলেরা জীবাণু থাকতে পারে এবং তা খেলে মানুষ কলেরা আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত রোগীর বমি ও মলের মাধ্যমে অনেক সময় এ রোগের বিস্তার ঘটতে পারে তবে সেই সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ ও অস্বাভাবিক।
কলেরা রোগের উপসর্গ : প্রতি ২০ জন রোগীর মধ্যে অন্তত একজন গুরুতর আক্রান্ত রোগী থাকে। এই রোগের উপসর্গ উল্লেখ করা হলো :
* প্রচুর পাতলা পায়খানা বা দাস্ত হওয়া, * দাস্তের সাথে প্রচুর বমি হতে পারে, * পানিস্বল্পতার জন্য পায়ের পেশি সঙ্কোচন হতে পারে।
পাতলা পায়খানা ও বমির সাথে দেহ থেকে পানি বেরিয়ে যাওয়ায় দেহে পানিশূন্যতা দেখা দেয় এবং রোগীর দেহ সাদা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এ অবস্থায় সময়মতো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই (এক ঘণ্টা) রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
অনেক সময় আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই রোগের উপসর্গ প্রকাশ পায় না। দুই-তিন দিন অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচ দিন পরেও রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক স্তরে রোগীর সাধারণ দাস্ত দেখা দেয় এবং শরীরে কিছুটা তাপ থাকে এবং জ্বর জ্বর ভাব দেখা দেয়। অনেক সময় কোনো ধরনের উপসর্গ ছাড়াই কলেরার সংক্রমণ হতে পারে। এই রোগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, প্রথমে পেটের ব্যথা হয় এবং সামান্য জ্বর থাকে। তার পরই শুরু হয় ঘন ঘন বমি ও পাতলা পায়খানা। মলের রঙ হয় অনেকটা চাল ধোয়া পানির মতো এবং তাতে ছোট ছোট মলের কণা দেখা যায়। বমি ও দাস্ত এত ঘন ঘন হতে থাকে যে এক ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় এক লিটার পানি বেরিয়ে যায়। এ অবস্থায় দেহে পানিস্বল্পতা পাঁচ থেকে ১০ লিটার পর্যন্ত পূরণ করা না গেলে রোগীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে যেতে পারে। পানিশূন্যতার কারণে শরীরের ত্বক সঙ্কোচন ও পেশি সঙ্কোচন ছাড়াও গলার স্বর অস্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া এ অবস্থায় রোগীর বিষণœতা দেখা দেয়, উপলব্ধি শক্তি লোপ পায় এবং বিভ্রান্তি দেখা দেয়। একই সাথে রক্তে লবণের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে শরীরের ভারসাম্য লোপ পায়। শিশুদের ক্ষেত্রে শরীরে খিঁচুনিসহ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
স্বল্পমাত্রার কলেরা সংক্রমণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আপনাআপনি ভালো হয়ে যায় কোনো প্রকার চিকিৎসা ছাড়াই। কিন্তু জটিল ও গুরুতর আক্রান্ত রোগীকে সময়মতো চিকিৎসা করা না হলে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি হয়। উন্নয়নশীল দেশে চিকিৎসা ছাড়া রোগীদের মৃত্যুহার প্রায় ৬০ শতাংশ হলেও সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা যথাসময়ে দেয়া গেলে মৃত্যুহার এক শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে এবং সেই সব রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করে সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারে।
পূর্বসতর্কতা
* ফুটানো পানি অথবা বৈজ্ঞানিক উপায়ে জীবাণুমুক্ত বিশুদ্ধ পানি পান করা, * গরম কফি অথবা গরম চা ও জীবাণুমুক্ত পানীয় পান করা। বোতলজাত মিনারেলযুক্ত পানীয় সাধারণত বিপদমুক্ত, * উচ্চতাপে দুধ ফুটিয়ে খাওয়া নিরাপদ, * বিশুদ্ধ পানির বরফ ব্যতীত অন্য কোনো বরফ টুকরো পানীয়তে মিশিয়ে পান করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়, * প্রয়োজনীয় তাপমাত্রায় খাবার তৈরি করে গরম থাকতেই তা পরিবেশ করা, যদি ঘরের সাধারণ তাপমাত্রায় কয়েক ঘণ্টা কোনো খাবার রাখা থাকে, তবে তাতে রোগ-জীবাণুযুক্ত হয়ে খাবার দূষিত করতে পারে, * কঠিন দেহাবরণের মাছ, কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক ও চিংড়িজাতীয় জলজ প্রাণীর মাংস এবং অপরিশোধিত কাঁচা ফলমূল খাওয়া থেকে বিরত থাকা, * অপরিশোধিত কাঁচা শাকসবজি খাওয়া পরিহার করা, * রাস্তার পাশের উন্মুক্ত দোকানের খাদ্য খাওয়া পরিহার করা।
উপরি উক্ত কয়েকটি পরামর্শ মেনে চললে শুধু কলেরা নয়, সব ধরনের রোগের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকা যাবে। জীবনহানিকর অনেক জীবাণু শুধু ফুটন্ত পানিতে বিনষ্ট হয় না, তাই খাবার সংরক্ষণের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কলেরার ইনজেকশন বা মুখে খাওয়া অনেক প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হলেও তার প্রয়োগে কলেরা থেকে শতভাগ নিরাপদ থাকা যায়। সেই সাথে উল্লিখিত সতর্কতা মেনে চললে এ থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারব। সবচেয়ে জরুরি ও কার্যকর বিষয় হলো পর্যাপ্ত চিনি ও লবণ মিশ্রিত পানি (স্যালাইন) পান করা। ঘন ঘন বমি হলেও তার ফাঁকে ফাঁকে রোগীকে স্যালাইন খাইয়ে যেতে হবে। বাজারে লবণ ও চিনিযুক্ত পাউডার (স্যালাইন) পাওয়া যায়, যা পানিতে গুলিয়ে রোগীকে খাওয়ানো যায়।
পাতলা পায়খানা ও বমির সাথে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া পানি যত শিগগির সম্ভব পুনঃসঞ্চারণ করে অতি সহজেই কলেরা রোগ প্রতিহত করা যায়। যদি পানি বা স্যালাইন খাওয়ার শক্তি রোগীর না থাকে তবে সেই পানিশূন্যতা যত তাড়াতাড়ি পূরণ হবে ততই মঙ্গল এবং সেই সাথে রোগের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, অণুজীববিজ্ঞান (মাইক্রোবায়োলজি) বিভাগ, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, ৯ বনানী বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা।